লুপ্তপ্রায় বড়বিল – এক বিলের মৃত্যু ও হাজারো জীবনের কান্না
যখন কোনও জলাশয় কেবলই জল নয়, হয়ে ওঠে মানুষের স্মৃতি, জীবিকা, ভালোবাসা আর কান্নার প্রতিচ্ছবি —তখন সেই জলাশয়ের হারিয়ে যাওয়া মানে হাজারো জীবনের টুকরো টুকরো মৃত্যু।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গি ব্লকের খয়রামারী, ঘোষপাড়া ও সাদিখানদেয়ার অঞ্চলের মাঝখানে অবস্থিত এক বিস্তীর্ণ বিল — বড়বিল। এই বিলের নামেই পার্শ্ববর্তী গ্রামটির নাম বড়বিলা। আর এই বিলকে ঘিরেই ছড়িয়ে রয়েছে সিতানগর, রওশননগর, প্রসন্ননগর, এনায়েতপুর, ঘোষপাড়া, ঝাউদিয়া, হুকোহারা – আরও অনেক গ্রাম একসময় এই ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বিলটি হয়ে উঠেছিল গোটা অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। প্রায় ৪,০০০ বিঘা জমি চাষ হতো এই বিলে নির্ভর করে। ধান, পাট, শাকসবজি — শুধু ফসল নয়, এই বিল দিয়েছিল বেঁচে থাকার রসদ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ, উৎসবের খরচ, পরিবারের স্বপ্ন।
আজ সেই বিলের বুক ভরিয়ে রয়েছে নিস্তব্ধতা আর কচুরিপানা। পদ্মা নদীতে সুইচগেট বসানোর পরে এই বিলে আর বর্ষার জল আসে না আগে বর্ষায় পদ্মার জল ঢুকত, আবার নিকাশির সুব্যবস্থার ফলে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যেত। আজ নিকাশির পথ সব বন্ধ — ক্যানেলগুলো জঞ্জালময়, সংস্কারের বালাই নেই। ফলে বর্ষার পরেও বিলের বুকজুড়ে থেকে যায় থমকে থাকা জল — আর জন্ম নেয় কচুরিপানার দানবীয় সাম্রাজ্য।
একসময় এই বিলের ওপর দিয়ে গ্রামের কৃষকরা নৌকায় করে জমিতে যেতেন। আজ কচুরিপানা জমে তাদের পথ আটকে দিয়েছে।জল দেওয়ার মেশিন কাঁধে নিয়ে কচুরিপানার ওপর দিয়ে হেঁটে পার হওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে। যদি কচুরিপানা না থাকত, তাহলে হয়তো আজও নৌকায় চেপে কৃষকরা চাষে যেতেন। এই বিলে একসময় বিয়ের অনুষ্ঠানে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া হতো নৌকায়। নৌকার ছলছল শব্দ, মাঝে মাঝে বনভোজনে হাসির হিল্লোল — সবই আজ হারিয়ে গেছে সময়ের নদীতে। এই বিল ছিল মানুষের স্নানের জায়গা, আড্ডার স্থান, শিশুর খেলাধুলা, বৃদ্ধের বিশ্রাম। ছাত্রছাত্রী থেকে গৃহবধূ — সবাই এখানে আসতেন, মিলেমিশে জীবনের দিনগুলো কাটাতেন।
আজ সেখানে কেউ আসে না। শুধু ভেসে আসে পুরনো দিনের দীর্ঘশ্বাস। কেউ একজন বলেছিলেন, “আমাদের ছোটবেলায় এক জমিদারের ছেলে সাইকেল নিয়ে এই বিলে ঝাঁপ দিত। এখন ভাবলে যেন গল্প মনে হয়… কিন্তু ওটা সত্যি ছিল। আমাদের জীবনের একটা অংশ ছিল।” আজ সেই জীবন নেই। রয়ে গেছে শুধু চোখে জল, আর অকথিত ব্যথা। এখানে আগে হতো প্রচুর মাছ —পুঁটি, শোল, টেংরা, জিওল, বোয়াল, কাতলা, গজার —আজ কিছুই নেই। কয়েকটি পরিবার এখনো জাল ফেলে — কিন্তু একটু হাওয়া দিলেই কচুরিপানা এসে জাল ছিঁড়ে দেয়, ডুবে যায় আশা। ১০০ টাকার মাছের আশায় জাল ফেলে, হাজার টাকার ক্ষতি নিয়ে বাড়ি ফেরে।
এই বিলের উপর নির্ভর করা মৎস্যজীবীরা আজ অসহায়। কারও হাতে কিছু নেই — তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই মুম্বাই, কেরালা কিংবা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে রুজির টানে। তারা আজ পরিযায়ী শ্রমিক।আজ যে পুকুরগুলো দেখা যায়, তা এই বিলেই কাটা হয়েছে। এই বিল যেখানে একসময় সবাইকে একসাথে বাঁচতে শিখিয়েছিল, আজ সেখানে শুধু জমির মালিকেরাই মাছ চাষ করে উপার্জন করছে —বাকি সাধারণ মানুষ খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এই বিল এখন আর বাঁচতে চায় না —শুধু নীরবে ডুবে থাকতে চায় এক জীবন্ত অতীতের মধ্যে। একসময় এই বিলের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো ছিল কাদা মাখা পথ। ছেলেরা গামছা পরে কাদা পার হয়ে স্কুলে যেত, শুকনো জায়গায় গিয়ে ড্রেস পরে ক্লাস করত।আজ সেখানে পিচঢালা রাস্তায় বাইক চলে, স্কুলও হয়েছে পাকা দালানে। তবু মানুষের মন আজও সেই বড়বিলের ছায়ায় ফিরে যায়।
বড়বিল শুধু একটি বিল নয় — এটি ছিল এই অঞ্চলের আত্মা। এর মৃত্যু মানে কেবল একটি জলাশয়ের শেষ নয়, এর অর্থ হাজারো জীবন, স্মৃতি, এবং ভালোবাসার নিঃশব্দ বিলুপ্তি।
এই গল্প তাই ধরণীগাথায় জায়গা পায়, কারণ এখানে আমরা সেই কণ্ঠগুলো শুনি, যারা এতদিন আলোয় আসেনি।

0 Comments