খয়রামারি ফেরিঘাট : দুর্ঘটনার ভয় নিয়েই চলছে প্রতিদিনের যাতায়াত
সমস্যার ছবি
মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি ব্লকের খয়রামারি থেকে কাশিপুর— দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার মতো। অথচ এই সামান্য পথই যেন এক গভীর ফাঁক। এ দুই জায়গার মধ্যে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা হলো নদীপথ, যেটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত দামোশ বিল নামে।
প্রায় আশি বছর ধরে খয়রামারির মানুষ একই ভরসায় বেঁচে আছেন— ছোট ছোট নৌকা। এপার থেকে ওপার যেতে এর বিকল্প নেই। যদি কেউ সড়কপথ ধরতে চায়, তবে মাত্র এক কিলোমিটারের জন্য ঘুরে আসতে হয় ২২–২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ।
প্রতিদিন কয়েকশো মানুষ ভরসা রাখেন এই ফেরিঘাটের ওপরে। কৃষকের মাঠের ফসল আনা, কর্মজীবী মানুষের কর্মস্থলে যাওয়া— সবকিছুই আটকে আছে এই নদীপথের দোলাচলে। নদীই যেন হয়ে উঠেছে তাদের জীবন আর স্বপ্নের মাঝের এক অনিবার্য সীমানা।
শুধু যাত্রী নয়, এই ফেরিঘাটে নৌকা চালিয়েই কিছু পরিবারের চুলায় আগুন জ্বলে, পেটে খাবার ওঠে। তাই নৌকা এখানে শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, জীবিকারও উৎস।
দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট
এই নৌযাত্রা কখনোই সহজ হয় না। বর্ষাকালে নদীর জল ফুলে ওঠে, স্রোত বেড়ে যায়, আর সঙ্গে বাড়ে মানুষের আতঙ্ক। মাঝেমধ্যে একটু বাতাস উঠলেই নদীর ওপরে ছড়িয়ে থাকা কচুরিপানা নৌকার পথ আটকে দেয়। তখন ওপার থেকে এপারে পারাপার করতে গিয়ে মাঝিদের ঘাম ঝরে, জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নৌকা চালাতে হয়।
কৃষকদের জন্য এই দুরবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। জমির ধান-গম সরাসরি নদীপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়েই তাদেরকে দূরবর্তী সড়কপথে ঘুরে যেতে হয়। মাত্র এক কিলোমিটারের জায়গা পার হতে তাদেরকে ২২–২৫ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয়, খরচ বাড়ে বহুগুণে, লাভের অঙ্ক কমে যায় চোখে পড়ার মতো। অনেক সময় ভোর থেকে রাত অবধি শুধু ফসল ঘরে তুলতেই লেগে যায়। এই বাড়তি ঝক্কিই হয়ে উঠেছে কৃষকের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা।
মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও ঘটে। কখনো কন্ট্রোল হারিয়ে নৌকো তলিয়ে যায় নদীর গভীরে। তখন এলাকার মানুষ ছুটে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন ঠিকই, কিন্তু জিনিসপত্রের ক্ষতি হয়েই থাকে। আজ পর্যন্ত বড় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, তবে সামনে এমনটা হবে না— তা বলা যায় না। প্রতিদিন বুক চেপে এই ভয় নিয়েই নদী পাড়ি দেন মানুষজন।
মানুষের দাবি ও আশা
এলাকার সাধারণ মানুষের দাবি একটাই— এই নদীর ওপর একটি সেতু দরকার।
যদি সেতু তৈরি হয়, তবে কয়েক মিনিটেই পারাপার সম্ভব হবে। কৃষকের ধান-গম নিরাপদে ও দ্রুত ঘরে পৌঁছবে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা সময়মতো স্কুলে পৌঁছবেন, রোগী দ্রুত হাসপাতালে যেতে পারবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, জীবনের ঝুঁকি থাকবে না।
গত কয়েক দশকে মানুষ বহুবার সরকারি দফতরে আবেদন জানিয়েছেন, নির্বাচনের সময় ভোটের প্রতিশ্রুতিও শুনেছেন। কিন্তু আজও সেই দাবি কাগজের মধ্যে আটকে আছে, বাস্তবে মেলেনি কোনো সমাধান।
ফলে খয়রামারির মানুষ আজও দাঁড়িয়ে আছেন ফেরিঘাটে, প্রতিদিন নদী পাড়ি দিচ্ছেন অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে। তাদের চোখে একটাই প্রশ্ন— কবে আসবে সেই সেতু, যা তাদের দুঃখের ইতিহাস মুছে দিয়ে নতুন ভোর এনে দেবে? কবে মিলবে একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস?

0 Comments